টেলিভিশনের পর বিজ্ঞাপনের বিপ্লব: ব্র্যান্ড আইডেন্টিটির ক্রমবিকাশ
উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে টেলিভিশনের উত্থান বিজ্ঞাপন জগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এই দৃশ্যমান মাধ্যম শুধু যোগাযোগের ধরনই বদলে দেয়নি, বরং ব্র্যান্ড আইডেন্টিটির সম্পূর্ণ ধারণাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল।
রেডিও থেকে টেলিভিশনে রূপান্তর
১৯৫০ সালে মাত্র ৯% আমেরিকান পরিবারে টেলিভিশন ছিল। কিন্তু ১৯৫৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫% এ। ১৯৬০ দশকের শুরুতে এই অনুপাত ছাড়িয়ে যায় ৯০%। এই দ্রুত পরিবর্তন বিজ্ঞাপনদাতাদের বাধ্য করে রেডিওর কথ্য শব্দ থেকে টেলিভিশনের দৃশ্যমান মাধ্যমে স্থানান্তরিত হতে।
টেলিভিশনের এই প্রভাব বিশাল ছিল। যেমন Rosser Reeves, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের একজন প্রধান স্থপতি বলেছিলেন: "আমরা আবিষ্কার করেছিলাম যে এটি কোনো নিরীহ বিড়ালছানা নয়; আমাদের হাতে ছিল একটি হিংস্র মানুষখেকো বাঘ। আমরা প্রিন্ট বা রেডিও থেকে একই বিজ্ঞাপন প্রচারাভিযান নিয়ে টিভিতে দিতে পারতাম, এবং এমনকি যখন খুব কম সেট ছিল, তখনও বিক্রয় আকাশ ছোঁয়া হয়ে যেত।"
ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটির গুরুত্ব
টেলিভিশনের আবির্ভাব ছবি-কেন্দ্রিক যোগাযোগের যুগের সূচনা করে। কোম্পানিগুলো দ্রুত বুঝতে পারে যে একটি সুসংহত ভিজ্যুয়াল মেসেজ প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করতে অত্যাবশ্যক। ব্র্যান্ডের এই মূল পরিচয় বা "Brand DNA" প্রতিবার দর্শকদের কাছে একই রকমভাবে উপস্থাপিত হওয়া জরুরি ছিল।
গ্রাফিক ডিজাইনও এই সময়ে বিজ্ঞাপনী ডিজাইনকে প্রতিস্থাপন করে। ১৯৫০ দশকে বেশিরভাগ এজেন্সি নিজস্ব শিল্পীদের ছেড়ে দিয়ে বাইরের স্টুডিওর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই স্টুডিওগুলো প্রচারমূলক পরিচয়ের ক্ষেত্রে নিজেদের গ্রাফিক ডিজাইন হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে।
যুগান্তকারী ব্র্যান্ড ক্যাম্পেইনসমূহ
ভক্সওয়াগেনের "Think Small" ক্যাম্পেইন
ভক্সওয়াগেনের ১৯৫৯ সালের "Think Small" ক্যাম্পেইন বিজ্ঞাপন জগতে বিপ্লব এনেছিল। বড় গাড়ি মানে উচ্চ সামাজিক মর্যাদার প্রতীক - এই ঐতিহ্যবাহী ধারণার বিপরীতে ভক্সওয়াগেন বিটল ছোট হওয়ার গুণটিকেই তার প্রধান বিক্রয়ের পয়েন্ট বানিয়েছিল।larryagency+1

ক্যাম্পেইনটির সৌন্দর্য ছিল তার সরলতা এবং সততায়। প্রচুর সাদা স্থান, বিটলের ছোট ছবি, এবং সরাসরি কিন্তু মজাদার কপি - এগুলো সেই সময়ের জমজমাট ও জটিল বিজ্ঞাপনের থেকে একদম আলাদা ছিল। "Lemon" এবং "It's ugly, but it gets you there" এর মতো আত্ম-সমালোচনামূলক কিন্তু সৎ বার্তা গ্রাহকদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে সফল হয়।thebrandhopper
Avis এর "We Try Harder" ক্যাম্পেইন
১৯৬২ সালে Avis তাদের "We Try Harder" ক্যাম্পেইন চালু করে, যা "২০ শতকের সবচেয়ে উজ্জ্বল বিজ্ঞাপনী স্লোগান" হিসেবে পরিচিত। নম্বর টু অবস্থানকে দুর্বলতা না ভেবে বরং শক্তিশালী সেবার প্রতিশ্রুতি হিসেবে ব্যবহার করেছিল Avis।carelinelive+1

তাদের মূল বার্তা ছিল: "আমরা সেরা নই, তাই আমাদের সার্ভিস বেস্ট হতেই হবে।" এই সততা ও নম্রতা গ্রাহকদের পক্ষে দাঁড় করায় এবং ব্র্যান্ডকে আরো মানবিক করে তোলে। এক বছরের মধ্যেই Avis দশকের বেশি সময় পর প্রথমবার লাভজনক হয়ে ওঠে।carelinelive+1
কোকা-কোলার "Hilltop" ক্যাম্পেইন (১৯৭১)
১৯৭১ সালে কোকা-কোলার "Hilltop" বিজ্ঞাপন emotional storytelling এর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় মাইলফলক হয়ে রয়েছে। ইতালির একটি পাহাড়ের চূড়ায় বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের একসাথে "I'd Like to Buy the World a Coke" গান গেয়ে বিশ্বব্যাপী একতার বার্তা দেওয়ার এই বিজ্ঞাপনটি শুধু একটি পণ্যের প্রচার ছিল না, বরং মানবতার শক্তিশালী ভাবনার প্রকাশ ছিল।historyoasis+1

এই প্রচারণার বিশেষত্ব ছিল এর স্পষ্ট ও জোরালো বার্তা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে এই বিজ্ঞাপন শান্তি ও সংহতির প্রতীক হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞাপনটির বাজেট ছিল $২৫০,০০০ (আজকের হিসাবে $১.৯ মিলিয়ন), যা সেই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন ছিল।mediashower+1
১৯৮০'র দশকে ব্র্যান্ডিংয়ে বিপ্লব: MTV এর উদাহরণ
১৯৮০'র দশকে এসে ব্র্যান্ডিং তার আনুষ্ঠানিক কর্পোরেট ধাঁচ থেকে বেরিয়ে আসে। এর নেতৃত্ব দিয়েছিল MTV। তাদের ক্রমাগত পরিবর্তনশীল লোগো ও বিদ্রোহী মনোভাব ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ডিং নিয়মকে ভেঙে ফেলে।creativebloq+1

MTV-র লোগো Manhattan Design দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল, যেখানে বড় ত্রিমাত্রিক "M" এবং গ্রাফিতি স্প্রে করা "TV" ছিল। কিন্তু এর আসল বৈশিষ্ট্য ছিল ক্রমাগত পরিবর্তন। রঙ, প্যাটার্ন, এবং অ্যানিমেশন - সবকিছুই বদলাতে থাকত। তাদের একমাত্র নিয়ম ছিল - সব নিয়ম ভাঙা।creativebloq+2
এই পদ্ধতি Memphis Design Movement থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল, যা রঙিন প্যাটার্ন ও হস্তনির্মিত চেহারার জন্য বিখ্যাত ছিল। MTV-র এই বৈচিত্র্যপূর্ণ কিন্তু সুসংগত পরিচয় যুব সংস্কৃতির সাথে নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল।axies+1
১৯৯০'র দশকে ইন্টারনেট এবং ডিজিট্যাল ব্র্যান্ডিং
১৯৯০'র দশকে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তার সাথে সাথে ব্র্যান্ডগুলো দ্রুত অনলাইনে আসতে থাকে, কিন্তু অনেকেই ডিজিটাল ডিজাস্টার তৈরি করে। বেশিরভাগ ওয়েবসাইট ছিল অগোছালো ও অকার্যকর।bowwe

প্রাথমিক ওয়েবসাইটগুলো ছিল প্রধানত টেক্সট-ভিত্তিক, নীল হাইপারলিঙ্ক যা ক্লিক করলে বেগুনি হয়ে যেত। ১৯৯৫ সালে CSS (Cascading Style Sheets) চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত ডিজাইন অপশন অত্যন্ত সীমিত ছিল।bowwe+1
অনেক ব্র্যান্ড মারাত্মক ভুল করে তাদের ওয়েবসাইটকে ডিজিট্যাল বিলবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করত, শুধু তাদের প্রিন্ট বিজ্ঞাপন কপি-পেস্ট করে দিত। এর ফলে প্রায়ই low-res, pixelated ছবি দেখা যেত, যেখানে ভালো ইউজার এক্সপেরিয়েন্সের কোনো ব্যাপার ছিল না।milkandtweed
ব্র্যান্ড সামঞ্জস্যের গুরুত্ব
এই সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যেও একটি বিষয় অপরিবর্তিত থেকেছে - ব্র্যান্ড সামঞ্জস্যের গুরুত্ব। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধারাবাহিক ব্র্যান্ড উপস্থাপনা রাজস্ব ১০-২০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে।adobe
ব্র্যান্ড সামঞ্জস্যের মূল উপাদানগুলো হলো:papirfly
-
ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি: লোগো, রঙের স্কিম, টাইপোগ্রাফি
-
কণ্ঠস্বরের টোন: যোগাযোগের ধরন ও ভাষা
-
ব্র্যান্ড মেসেজিং: মূল মূল্যবোধ ও প্রতিশ্রুতি
-
সোশ্যাল মিডিয়া: সামঞ্জস্যপূর্ণ অনলাইন উপস্থিতি
ব্র্যান্ডের রঙের ব্যবহার যদি এলোমেলো হয়, তাহলে তা প্রিন্টিং-এর সময় ভুল CMYK রঙ ব্যবহারের মতোই বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়। এতে গ্রাহকের বিশ্বাস নষ্ট হয় এবং ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা থাকে না।upscaleworldwide
উপসংহার
১৯৫০-এর পর থেকে টেলিভিশনের আবির্ভাব ব্র্যান্ড যোগাযোগে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। রেডিওর কথ্য শব্দ থেকে দৃশ্যমান মাধ্যমে স্থানান্তরের এই পরিবর্তন কেবল প্রযুক্তিগত উন্নতি ছিল না, বরং এটি ছিল ব্র্যান্ড আইডেন্টিটির সম্পূর্ণ ধারণাগত রূপান্তর।
ভক্সওয়াগেনের সৎ অবস্থান থেকে শুরু করে Avis-এর নম্র স্বীকারোক্তি, কোকা-কোলার আবেগময় গল্প, MTV-র বিদ্রোহী মনোভাব, এবং ইন্টারনেটের প্রাথমিক বিশৃঙ্খলা - প্রতিটি পর্যায়ে একটি বিষয় স্পষ্ট: শক্তিশালী, সামঞ্জস্যপূর্ণ Brand DNA ছাড়া কোনো ব্র্যান্ড টিকে থাকতে পারে না।
আজকের ডিজিট্যাল যুগেও এই মূল নীতিটি অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রযুক্তি পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু একটি সৎ, স্পষ্ট এবং ধারাবাহিক ব্র্যান্ড বার্তার প্রয়োজনীয়তা চিরন্তন।
Comments
Post a Comment